কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি :
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার একমাত্র শিল্পকলা একাডেমি ভবনটি এখন কেবল একটি ধ্বংসস্তূপের নাম। দীর্ঘ দুই যুগ (২৪ বছর) ধরে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, যেখানে একসময় নাটক, গান, আবৃত্তি ও নৃত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল, সেই স্থানটি এখন ময়লা-আবর্জনা ও মল-মূত্র ত্যাগের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক অবহেলা, জবাবদিহিতার অভাব এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সংস্কৃতি অঙ্গন আজ চরম সংকটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে, দেয়াল ফেটে গেছে, জানালা-দরজা ভাঙা। ভেতরের পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার ও দুর্গন্ধযুক্ত। উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের তথ্যমতে, ভবনটি আরও দুই যুগ আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ এর কোনো বিকল্প বা নতুন নির্মাণ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "জায়গাটা এখন ভুতুড়ে পরিত্যক্ত বাড়ির মতো দেখায়। ইউএনও তৎপর হলে শিশুরা দীর্ঘ দুই যুগ পিছিয়ে পড়ত না।"
দীর্ঘ দুই যুগের স্থবিরতায় কালিগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গন কার্যত 'মৃত'। সাবেক সংগীত শিক্ষক পলাশ মজুমদার জানান, এখানে শতাধিক শিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যকর্মী ও আবৃত্তিকার থাকলেও তাদের চর্চার কোনো সুযোগ নেই। সাতক্ষীরা জেলা নাট্যশিল্পী ও কালিগঞ্জ উপজেলা যাত্রা সমিতির সহসভাপতি সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, "আমাদের বাচ্চারা পিছিয়ে গেছে। গত ২৪ বছর এখানে সাংস্কৃতি চর্চা নেই। একাডেমি শুধু নামেই আছে, বাস্তবে মৃত।"
দেশ বরেণ্য ব্যান্ড শিল্পী ও কালিগঞ্জের কৃতি সন্তান সোহাগ (৬৪টি অ্যালবামের সংগীতশিল্পী) পরিস্থিতিকে "অপূরণীয় ক্ষতি" হিসেবে উল্লেখ করে দ্রুত ভবন নির্মাণ ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে সবচেয়ে গুরুতর যে তথ্যটি উঠে এসেছে তা হলো, শিল্পকলা একাডেমির নামে আসা সরকারি বরাদ্দ নিয়ে মারাত্মক অনিয়ম। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, প্রতি বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে বাজেট এলেও, সেই অর্থের কোনো স্বচ্ছ ব্যবহার হয় না।
জানা গেছে, ২০১০ সালে তৎকালীন ইউএনও ফারুক আহম্মেদের মাধ্যমে কালিগঞ্জে শিল্পকলা একাডেমির তথাকথিত "পকেট কমিটি"র সূচনা হয়। সেই থেকে আজও একাডেমির উন্নয়ন তহবিল সংস্কৃতি চর্চায় কাজে আসেনি।
উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক শান্তি চক্রবত্তী সরাসরি অভিযোগ করেন, "যা বরাদ্দ আছে তা আমরা চোখে দেখি না। সব পকেট কমিটির পকেটে।" স্থানীয় শিল্পীরা অভিযোগ করেছেন যে, প্রকৃত সংস্কৃতিকর্মীদের বাদ দিয়ে "দালাল বাটপারদের" দিয়ে বিল-ভাউচার তৈরি করে প্রশাসন এই অর্থ লোপাট করছে। সংগীত শিল্পী জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, "শিল্পকলার কোনো অস্তিত্ব নেই, অথচ বিল-ভাউচার হয়। টাকা-পয়সা কি করে তা আমরা জানি না।"
শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকলেও, বর্তমান সভাপতি অনুজা মন্ডলের সময়ে কোনো সভা, কার্যক্রমের প্রতিবেদন বা আর্থিক হিসাব সামনে আসেনি। এই বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। প্রবীণ নাট্যকর্মী নিরোদ মল্লিক প্রশাসনের নীরবতা প্রসঙ্গে বলেন, "এই একাডেমিকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রশাসন ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ দরকার। না হলে কালিগঞ্জের শিল্পচর্চা চিরতরে বিলুপ্ত হবে।"
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিকরা এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে ইউএনও ও ডিসি সাতক্ষীরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুত নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন: দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণ এবং পরিত্যক্ত ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কার্যকর ও স্বচ্ছ পরিচালনা কমিটি গঠন করা, ২০১০ সালের পকেট কমিটিতে জড়িতদের বহিষ্কার এবং প্রকৃত শিল্পীদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা, নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মসূচি চালু করা।
কালিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি কেবল একটি ভবন নয়, এটি কালিগঞ্জের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। দুই যুগের অবহেলা, অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাবে প্রাণবন্ত এই স্থান আজ নিঃস্তব্ধ। দ্রুত প্রশাসনের সঠিক উদ্যোগ ও নেতৃত্ব ছাড়া কালিগঞ্জের সংস্কৃতিচর্চা স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে।