March 9, 2025, 1:59 am
মোঃ ইশারাত আলী :
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে ভোটার তালিকায় ভুতুড়ে ভোটার থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত এসব ভুতুড়ে ভোটার ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে না আসলেও ভোটের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১ভোটে ভোটার প্রার্থী জয়পরাজয় বরণ করলেও অন্তরালে ভুতুড়ে ভোটে অনেক যোগ্যপ্রার্থী পরাজিত হয়। এমন অনেক ভোটার যারা আইনী জটিলতায় বছরের পর বছর জীবিত। অথচ বিগত ৪/৫টি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে তাদের ভোটকেন্দ্রে দেখা যায়নি বা তারা এলাকায় আসেনি। কিন্তু তারা ভোটার হিসেবে তালিকায় হালনাগাদ আছে।
কালিগঞ্জ উপজেলায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে গেল সোমবার। মোট ভোটার ২৫২৩৭১ জন। এর মধ্যে নতুন তথ্য সংগ্রহ হয়েছে। ৮হাজার ৩শত ৭৬ জনের। পুরুষ ৩ হাজার ৯শত ৩৭জন। মহিলা ৪হাজার ৪শত ৩৯জন এবং বাদ গিয়েছে ৩হাজার ২শত ৮২ জন। বিষয়টি জানিয়েছেন কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসার অনুজ গাইন।
তবে সরেজমিনে দেখাগেছে কালিগঞ্জের দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের শ্রীকলা গ্রামের বিষ্ণুপদ মন্ডল, পিতা প্রফুল্ল মন্ডল, জন্ম তারিখ ১৫ জানুয়ারী ১৯৫২ সাল। বিষ্ণুপদ মন্ডল (৮৭১১৭০০২২০০১) ৯নম্বর ওয়ার্ডের ০০১ নম্বর ভোটার বয়স এখন ৭৩ বছর। বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে তিনি ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেননি। এলাকায় তাকে কেউ দেখেনি। কিন্তু তিনি বিধিবিধান অনুযায়ী ভোটার তালিকায় ১নম্বরে।
দুলাল চন্দ্র মন্ডল, পিতা মেঘনাথ মন্ডল (৮৭১১৭০১০৩০৪২) নম্বর ভোটার, জন্ম ১৮ জুলাই ১৯৬০ সাল। তিনিও বিগত ৫টি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে আসেনি। অথচ ভোটার তালিকায় ০৪১ নম্বর ভোটার। এমন ভুতুড়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ হলে প্রতিহাজারে প্রায় ৩০ জন ভোটার ভোটের অন্তরালে থেকে যাবে এবং ঐ ৩০ ভোট জাল ভোটের সহায়ক হবে।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে ২০০৭ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরীর কাজ শুরু হয়। এরপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে ৬বার। ২০০৯-১০, ২০১২-১৩, ২০১৫-১৬, ২০১৭-১৮, ২০১৯-২০ ও ২০২২-২৩ সালে। বাড়ী বাড়ী গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হলেও ২০২২-২৩ সালের ভোটার তালিকা বহাল রেখে আবারও হালনাগাদ করা হচ্ছে। এর বাইরে শুধুমাত্র নতুন ভোটার সংযুক্ত ও মৃত ভোটার কর্তন করা হচ্ছে।
উপজেলার ৫নং কুশলিয়া ইউনিয়নের কুশলিয়া গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডের প্রশান্ত কুমার গাইন (৮৭১১৮৮৩৭৬১৩৮) একজন ব্যবসায়ী। তিনি এক যুগ আগে ইন্ডিয়া চলে গেছে। তার জন্ম তারিখ ১ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সাল। বিগত ৩টি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে তিনি দেশে আসেনি ভোট দিতে বা অন্য কোন কাজে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুশলিয়া গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বর সিরাজুল ইসলাম। অথচ তিনি ভোটার তালিকায় আছেন। তিনি ভোট না দিলেও বিগত বছর গুলোতে তার ভোটটি জাল ভোট হিসেবে প্রদান করা হয়েছে এমন অভিযোগ আছে। এরকম প্রায় ১০ হাজার ভোটার তালিকা ভুক্ত হলে হালনাগাদ ভোটার করার যে লক্ষ্য তা পুরণ না হয়ে ব্যর্থ হবে।
তালিকায় নাম আছে কিন্তু অভিভাবক সঠিক নয় এমন অনেক নাম রয়ে যাচ্ছে হালনাগাদ ভোটার তালিকায়। তারা কারা এবং তাদের পরিচয় কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আবার আইনী বাধ্যবাধকতায় তাদের নাম ভোটার হিসেবে হালনাগাদ তালিকায় থেকে যাচ্ছে। এমন জটিলতা সমগ্র উপজেলা জুড়ে।
আমরা উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডে ভোটার তালিকা ধরে একটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, প্রতিহাজারে প্রায় ৩০জন কোথাও কোথাও আরও বেশী সংখ্যক ভুতুড়ে ভোটার তালিকায় থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসার অনুজ গাইন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমাদের করার কিছু নেই।
আমরা একটি খসড়া তালিকা পাবো কিনা জানতে চাইলে তিনি সাফ জবাব দেন “না”। এসময় জানতে চাই, যাদের বয়স ৭৫ বছর, ১৫ বছর আগে অন্যত্র চলে গেছে। এখন তার বয়স ৯০ বছর বা অন্য কারো ১২০ বছর। তিনি বিগত ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি, তাকে কি করবেন? তিনি বলেন যে, তাকে আমরা ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করতে পারবোনা। তার মৃত্যু সনদ দিতে হবে।
আমারা এরকম কয়েকটি নাম নিয়ে কালিগঞ্জের দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদে যাই তাদের মৃত্যু সনদ নিতে। কিন্তু পরিষদের সচিব বিশ^জিৎ সরকার তাদের নাম মৃত্যু সনদ তালিকায় খুঁজে পাননি। বিষয়টি উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে জানালে তিনি বলেন, তাহলে তার পরিবারের পক্ষে কেউ নিশ্চিত করেবে। কিন্তু ঐপরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেকারনে নির্বাচন অফিস তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়নি।
আমরা নির্বাচন অফিসার অনুজ গাইনকে প্রশ্নকরি একজন মৃত ভোটারের বয়স ১১০ বছর, ২০ বছর পরে তার বয়স হবে ১৩০ বছর, তাকে ভোটার তালিকায় রাখবেন কিনা? তিনি বলেন যে, মৃত্যু সনদ কেউ না দিলে তার নাম ভোটার তালিকায় থাকবে। মৃত্যু সনদ না দিলে ১৫০ বছর হলেও তার নাম ভোটার তালিকায় থাকবে।
তাহলে এই সমস্যা নিরসণে করণীয় কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, আইনের সংশোধনী, জনসচেতনতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভূমিকা এই সংকট থেকে কাটিয়ে উঠতে পারে।
কালিগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার ইউনিয়নে এমন ভুতুড়ে ভোটার অনেক আছে। আমি চাই ছাত্র জনতার বিপ্লবের পর একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা হালনাগাদ হোক।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কালিগঞ্জ শাখার সেক্রেটারী, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, বিষয়টি আমরা নির্বাচন অফিসার অনুজ গাইন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মন্ডলকে অবহিত করেছি। আমরা জনসচেতনা তৈরীর জন্য কাজ করবো। সাথে সাথে এমন ভুতুড়ে ভোটার হালনাগাদ তালিকায় যেন অন্তভূক্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবো।
বিষয় গুলো কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মন্ডল এর কাছে উপস্থাপন করলে তিনি বলেন যে, বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে এই ঝামেলা গুলো থাকলে এখানে জাল ভোট পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু একটা মানুষ অন্য কোথাও বসবাস করছে, হতে পারে ঢাকায় হতে পারে অষ্ট্রেলিয়ায় কিন্তু তাকে আমরা ভোটার হিসেবে যদি নাম কর্তন করি তবে সে নাগরিক হিসেবে সুবধাভোগী হবেনা। এটার আইনগত ভিত্তি নাই এটা করা যাবেনা। যাদের বয়স বেশী হয়েগেছে কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম আছে, ডকুমেন্ট ছাড়া দায়িত্ব নিয়ে কর্তন করতে গেলে নিবাচন কমিশন প্রশ্নের মুখে পড়বে। আমরা বরং চেষ্টা করতে পারি যে, কিভাবে ঐ মানুষ গুলোর মৃত্যু দিয়ে দেওয়া যায়। তার পরেও আমরা চেষ্টা করছি সকলের সহযোগিতা নিয়ে একটি সঠিক তালিকা হালনাগাদ করার।##
Leave a Reply