মোঃ ইশারাত আলী:
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের কথা বলা হলেও সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষা খাতে তার বাস্তব চিত্র হতাশাজনক। এখানে অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও সরকারি দপ্তরে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও কার্যকর স্পিড না থাকায় ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত আদায় হচ্ছে বিপুল অঙ্কের ইন্টারনেট বিল। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ডিজিটাল শিক্ষার নামে কি রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট হচ্ছে?
বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কালিগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ইউনিয়ন পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও সরকারি দপ্তরগুলোতে সরকারি ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। তবে বাস্তবে সেই সংযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাস, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, ই-ফাইলিং বা ডিজিটাল হাজিরা চালানো প্রায় অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট স্পিড এতটাই কম যে একটি সাধারণ ওয়েবসাইটও লোড হয় না।
আরও জানা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১০–২০ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথের ইন্টারনেট প্যাকেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী একসঙ্গে ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে নেটওয়ার্ক চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়, ফলে ভিডিও ক্লাস ও অনলাইন কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের একজন জানান, ব্যান্ডউইথ আপগ্রেড না করেই শিক্ষার্থী, ডিভাইস ও ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। এতে ভেন্ডাররা লাভবান হলেও শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম ডিজিটাল সুবিধা থেকে।
তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, ইন্টারনেট ভেন্ডাররা সংযোগ দেওয়ার সময় উপজেলা আইসিটি অফিস সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে অলিখিত সমঝোতায় পৌঁছায়। পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে অফিসিয়াল নির্দেশনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংযোগ দেওয়া হয়। সংযোগ দেওয়ার পর আর কোনো মান নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মিত তদারকি নেই।
হিসাব অনুযায়ী, কালিগঞ্জ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরগুলো থেকে প্রতি বছর কোটি টাকার উপরে ইন্টারনেট বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। অথচ কার্যকর সেবা না থাকায় এই অর্থ রাষ্ট্রীয় অপচয় ও সম্ভাব্য অনিয়মের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কালিগঞ্জ সদর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আল আমিন হোসেন বলেন, “ইন্টারনেট সংযোগ আছে শুধু নামেই। কোনো কাজে আসে না। বাধ্য হয়ে নিজের টাকা দিয়ে ইন্টারনেট কিনে অফিসিয়াল কাজ করতে হয়।”
ভদ্রখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, “এইচ এম কমিউনিকেশ“ (HM Communication) নামে একটি ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান আমাদের স্কুলে সংযোগ দিয়েছে। কিন্তু ছয় মাস ধরে কোনো নেট স্পিড নেই। ভিডিও ক্লাস চালাতে গেলে বারবার লোডিং হয়, অনেক সময় পুরো ক্লাসই বন্ধ হয়ে যায়।” আমরা বিষয়টি নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে আছি।
কালিগঞ্জ সরকারি কলেজের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “সরকারি লাইনে কোনো স্পিড নেই। জরুরি কাজে মোবাইল ডেটা ব্যবহার করতে হয়। এর বাইরে একটি বেসরকারী ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান থেকে সংযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়।এতে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।”
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার দীপক কুমার বিশ্বাস জানান, তিনি নিজেও ব্যক্তিগত খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং কোনো ভেন্ডারের বিষয়ে অবগত নন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “কোন স্কুলে কোন ভেন্ডার ইন্টারনেট দিচ্ছে, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।”
ইন্টারনেট ভেন্ডার গুলো সংযোগ দেওয়ার সময় উপজেলা আইসিটি অফিসারের সাথে বিশিষ সুবিধার মাধ্যমে একটি আলাদা অলিখিত চুক্তি করে। পরে সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরের কর্মকর্তার সাথে দেনদরবার করে অফিসিয়াল নির্দেশনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। এরপরেই ইন্টারনেট বিড়ম্বনার কবলে পড়ে কোমলমতি শিশু ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাসের সাথে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান। উপজেলা আইসিটি অফিসার হেমেন্দ্র নাথ মণ্ডল ২০১৯ সাল থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। তার সময়ে কোটি কোটি টাকার ডিজিটাল দুর্নীতি হয়েছে। তিনিই স্বীকার করে বলেন যে ইনফো সরকার ১, ২ ও ৩ প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেট সেবা মারাত্মকভাবে বিপর্যয় হয়েছে। বর্তমান কি অবস্থা তিনি জানেননা এবং এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে তিনি ভেন্ডরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ইন্টারনেট স্পিড প্রায় শূন্য হওয়ায় খোদ ইউএনও অফিস বেসরকারি ভেন্ডারের সংযোগ নিয়ে ইন্টারনেট চালাচ্ছেন। সেকারনে ইউএনও সহ সকল দপ্তর নিয়মিত অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করছে। পরিশোধ যোগ্য বিল ভুতে যোগায় এমন প্রশ্ন উঠেছে।
সাতক্ষীরার এইচ এম কমিউনিকেশন এর মালিক মোঃ জাহাঙ্গির আলমের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি গত জুনে একটি চুক্তি হয়েছে। আমরা এখনো কোন বিল পাইনি। যে কারনে ইন্টারনেট স্পিড বাড়াতে পারছিনা। আমরা বিল পেলে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। পুনরায় তাকে জিঙ্ঘেস করা হয় যে চুক্তি অনুযায়ী আপনারা সরকারের কাছ থেকে বিল নিবেন কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিস গুলো ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কি বলবেন? তিনি বলেন আপাতত কিছু করার নেই। তবে সব কিছু ঠিকঠাক চলছে।
প্রশ্নে উঠেছে কার্যকর সেবা না দিয়েও কীভাবে নিয়মিত বিল উত্তোলন হচ্ছে? ভেন্ডার নির্বাচনে সরকারি ক্রয় বিধিমালা মানা হয়েছে কি না? মান নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা কেন দায় এড়াচ্ছেন? নাকি খবরের অন্তরালে অন্য কোন চুক্তি হয়েছে।
কালিগঞ্জে বিভিন্ন সরকারী দপ্তর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগ আছে সেবা নেই কিন্তু বিল হয়। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসার মোঃ নাজিম উদ্দিন এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, আমার দপ্তরে একটি সরকারী সংযোগ আছে কিন্তু তাতে ইন্টারনেট স্পিড নেই। আমি একটি বেসরকারী ভেন্ডরের কাছ থেকে লাইন নিয়ে চালাই। আমার কাছে উপজেলা পরিষদের ইন্টার নেট বিল আসে। আমি সে বিল প্রদান করি। তবে এইচ এম কমিউনিকেশন নামে কোন প্রতিষ্ঠান আমি চিনিনা বা জানিনা।
কালিগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাতক্ষীরার এইচ এম কমিউনিকেশন নামে একটি ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান সংযোগ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু সংযোগটি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারেন না। বিষয়টি আপনি জানেন কিনা? উত্তরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার বলেন বিষয়টি আমি দেখছি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শিক্ষা খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কালিগঞ্জে ইন্টারনেট সংকট সেই অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অনুসন্ধানে স্পষ্ট, এই সমস্যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং দায়িত্বহীনতা ও নজরদারির ঘাটতির ফল সাথে লুটপাটের হিসেব। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ডিজিটাল শিক্ষার স্বপ্ন কেবল কাগজেই থেকে যাবে, আর এর খেসারত দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।