বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৫ পূর্বাহ্ন

ভাটা শ্রমিক ও ভাটা মালিক বনাম করোনা ভাইরাস এবং লাশের রাজ্য

ভাটা শ্রমিক ও ভাটা মালিক বনাম করোনা ভাইরাস এবং লাশের রাজ্য

ইশারাত আলী :
আমাদের সাতক্ষীরায় এখন নিয়মিত বিরোতিতে ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশের গাড়ী ও এ্যাম্বুলেন্সের উচ্চ শব্দ শোনা যাচ্ছে। সঙ্গত কারনে বাড়ীর সবচেয়ে প্রবীণ মানুষ আমার মা। তার জিঙ্ঘাসা, কে মরলো আবার। জবাব দেওয়ার কিছু নেই। কারন আমিও উদ্বিগ্ন এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনে। সত্যিই বেঁচে থেকে একটি মৃত্যু যন্ত্রনা শুরু হয়েছে হৃদয়ে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে উহানে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রাণঘাতি ছোঁয়াচে ভাইরাস আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১লক্ষ ৩৭হাজার ৬৭ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে। আমাদের দেশে ৮ মার্চ দুপুরে ঘোষনা আসে যে, গতকাল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। আজ ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১হাজার ৪শত ৬৩জন এবং মৃতের সংখ্যা ৬০জন।
সংখ্যা দিয়ে কিবা হবে প্রশ্ন সবার কাছে। খোদ চীন, ইতালী, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ক্যানাডা সহ পারমানবিক শক্তিধররা কুপোকাত করোনা ভাইরাসে। সেখানে সাতক্ষীরা আক্রান্ত জনপদ হলে আমরা হবো লাশের রাজ্যের নাগরিক এবং নাটকিয় মোড় না নিলে সাতক্ষীরা হবে ইতালী কিম্বা আমেরিকার চেয়ে ভয়াবহ।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ আক্রান্ত হওয়ার পরে আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল। কিন্তু সে সময়ে আমরা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। বিলম্বে তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে।
তারপরেও আমাদের সাতক্ষীরার ডিসি, এসপি সিভিল সার্জন এবং সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যোন সহ সেনাবাহেনী, পুলিশও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৎপরতায় করোনা ভাইরাস অনেক খানী নিয়ন্ত্রন ছিল। কিন্তু হটাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলে মনটা খারাব হয়ে যায়।
সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ছুটি জটলা এবং দক্ষিণ অঞ্চালের প্রায় ২লক্ষ ভাটা শ্রমিককে ভাটা থেকে বিতাড়িত করার কারনে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতি শুরু হয়।
গামেন্টস শ্রমিকদের ঢাকা যাওয়া ও ফেরার ক্ষেত্রে সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়। কমপক্ষে ৩ফুট সামাজিক দুরত্ব তৈরী, বারবার হাত ধোওয়া, মুখে মাক্স পরা, করোমর্দন থেকে বিরতো থাকা ইত্যাদি নির্দেশনা থাকলেও তা উল্টে যায়। সেকারনে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বেশ উদ্বিগ্নতা তৈরী হয়।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সাতক্ষীরার প্রায় ২লক্ষ ইট ভাটা শ্রমিক, যার মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শিশু ও নারী শ্রমিক, মালিক ও সর্দার পক্ষের বলিরপাটায় পরিনত হয়ে ভাটা থেকে বিতাড়িত হয়। খাদ্য ও অর্থাভাবে তারা রাস্তায় নামে খালি হাতে। গনপরিবহন বন্ধ থাকায় কিছু সুযোগ সন্ধানী ট্রাক, সম্পূর্ণ নিয়োমনীতি তোয়াক্কা না করে গুড়ের মেটে কিম্বা কুমড়োর মতো সাজিয়ে ত্রিপোল দিয়ে ঢেকে পন্যজাত সামগ্রী হিসেবে সাতক্ষীরায় ঢোকে। কাভার্ড ভ্যানের ভিতর থেকে যেভাবে স্বেচ্ছাসেবকরা শ্রমিকদের উদ্ধার করেছে তা রীতিমতো লোমহর্ষক। সংক্রামিত ১জন থাকলে ঐ ট্রাকে আসা সকল শ্রমিক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সেকারনে শতভাগ নিশ্চিত।
বিভিন্ন সুত্র থেকে জানাগেছে প্রতিদিন রাত ১২টার পর থেকে সকাল ৮টার মধ্যে সাতক্ষীরায় কমের উপর ৮০ থেকে নব্বইটি ট্রাক ঢুকেছে এবং এই নব্বইটি ট্রাকে কমের উপর ৭হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার শ্রমিক আসে। তারা করোনা সংক্রামিত এলাকা নারায়নগঞ্জ, ঢাকা, মাদারীপুর, শরীয়াতপুর, গাজীপুর সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছে এবং ২৫এপ্রিল পর্যন্ত ফেরার ধারা অব্যাহত থাকবে। আজ যারা আসলো তারাও অত্যান্ত ঝুকি নিয়ে আসলো।
করোনা ভাইরাসের অজুহাতে ভাটা মালিকরা শ্রমিকদের হিসেব শেষ না করে তড়িঘড়ি তাদের বের করে দেয়। যারফলে স্থানীয় ভাবে একটি বিব্রতকর পরিবেশে পড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও শ্রমিকরা। অথচ এই শ্রমিকদের পরিশ্রমে এক একটি ভাটা মালিক কমের উপর ৩কোটি টাকা লাভ করে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে ঠিক সেই শ্রমিকদের টাকা বুঝে নাদিয়ে সর্দারদের সাথে যোগসাযোগ করে ভাটা মালিকরা তাদের করোনা ভাইরাসের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সরকারী দলের অনুকম্পায় চলার কারনে স্থানীয় প্রশাসন ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধেকোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি বলে অভিযোগ আছে।
অনেক শ্রমিক বলেছে তাদের হাতে কোন টাকা না দিয়ে বের করে দিয়েছে। রাস্তায় পরিবহন নেই, খাওয়া নেই তার উপর করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক। একারনে তারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছে।
শ্রমিকরা আসছে এবং ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত আসবে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। যারা করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক নিয়ে আসলো তারাও ঠিকঠাক হোম কোয়ারেনটাইন মানছেনা। আবার বিশেষ দায়িত্ব প্রাপ্তদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে চলছে অনেক শ্রমিক। বিস্তর অভিযোগ উঠেছে শ্রমিক ও কিছু কিছু জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মধ্যে করোনা ভাইরাস কিভাবে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জকে সবচেয়ে ঝুকি করে তুলেছে তার কিছু কারন উল্লেখ্য।
প্রত্যেক শ্রমিক রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৫টার মধ্যে অধিকাংশ কালিগঞ্জের নলতা, ভাড়াশিমলার মোড়, তারালীর মোড়, কলেজ মোড়, মৌতলা, খানপুর, কালিকাপুর, কাশিমাড়ি, জয়নগর, কৃষ্ণনগর, কদমতলা ও রতনপুর নেমেছে। অতপর তাদের ব্যহার্য্য জিনিসপত্র নিয়ে কোন ভ্যানে অথবা ইজিবাইকে উঠে বাড়ী গেছে। অতপর তারা বাড়িতে বিশ্রাম করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাইরে থাকার কারনে শরীরে জমা আবেগ স্ত্রীর উপর ঝেড়েছে। বাচ্চারা বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। ঐবাচ্চারা সকালে অন্য বাচ্চাদের ধরাধরি খেলেছে। এভাবে করোনা ভাইরাস জ্যামিতিক হারে সাতক্ষীরায় শতভাগ জেকে বসবে এবং মহামারী আকার ধারন করবে বলে ইতিমধ্যে অনেকে ধারনা করছে।
হোম কোয়ারেনটাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে যারা আছে তারা গভীর রাতে তাদের বাড়ী গিয়ে অবস্থান করছে এমন অভিযোগ আছে। এব্যাপারে অনেকের সাথে কথা বল্লে তারা বলে যে, আমাদের বাড়ীতে খাদ্য নেই, বাজার নেই। একারনে আমরা চেষ্টা করছি কিছু করার।
কিন্তু এখন তারা যাই করুকনা কেন তা হবে আতœঘাতি। ভাটা শ্রমিকদের লাগামহীন চলা ফেরা ও প্রশাসনের তরফে তাদের লাগাম টেনে ধরার গতি মন্থরতা বেশ ভাবিয়ে তুলছে। শ্যামনগরের কইখালী ইতালী পাড়া নামে খ্যাত। এরকম জেলার প্রতিটি উপজেলার একই অবস্থা।
আরেকটি অভিযোগ জোরালো হচ্ছে। ভোমরা স্থল বন্দর বন্ধ থাকার কারনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ রাতের আধারে যাতায়াত করছে পাসপোর্ট উল্টো পকেটে রেখে। সাতক্ষীরা সিমান্তের ১৮টি ইউনিয়নের কোননা কোন ঘাট দুষ্ট চক্র ব্যবহার করছে সুযোগ বুঝে। শোনা যাচ্ছে চুপিসারে পুশব্যাক হচ্ছে নাকি! যাই হোক সেটি বিষয় নয়। সাবধান হলে সমস্যা কমবে।
আমাদের সাতক্ষীরার জনসংখ্যা ২২ লক্ষ। সাধারণ জনগন গড়ে ২টাকার পরিমান টাকার অংকে ত্রান পেয়েছে। অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রীর হিসেব অন্যরকম। আমি সেখানে একটি কথা বলতে চাই বৈশ্বিক সমস্যায় সবাই জর্জরিত। সবার সহযোগিতা দিয়ে বাধ্যতামুলক হোম কোয়ারেনটাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে রাখার ব্যবস্থা করুন।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে খোদ আমেরিকা বিপাকে। আমাদের সাতক্ষীরার চিকিৎসা ব্যবস্থা সেখানে আরো অপ্রতুল। আমাদের প্রতি প্রায় ৮ হাজার জনের জন্য একটি মাত্র বেড। প্রায় ৩ লক্ষ রোগীর জন্য একটি ভেনটিলেটর। ১০ হাজারের কাছাকাছি রোগীর জন্য একটি অক্সিজেন। প্রায় ৩ হাজার মানুষের জন্য একটি নেবুলাইজার।
এজন্য হোম কোয়ারেনটাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইনে থাকা ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই। এতো বাজারের বাহাদুরী দেখিয়ে লাভ নেই। এখন ঘরে থাকতে হবে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে। গ্রামের বোনেরা, ভাবীরা বিকাল হলে সামাজিক দুরত্ব ভুলে যান। পুকুরের ঘাটে বা ফাঁকা মাঠে আড্ডাবাজি করেন। আপাতত এগুলো এড়িয়ে না চল্লে আপনি নিজেই করোনা রোগী হয়ে যাবেন। এই মুহুর্তে বেশ ঝুকির মধ্যে সাতক্ষীরা। আর তা যদি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সাতক্ষীরা হবে লাশের রাজ্য।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2013 www.satkhiranews24.com
Hosted By LOCAL IT